হীরের আঙটি
বাংলা ছোট গল্প:মণিদীপা ভট্টাচার্জ
===========
কলকাতা থেকে ফিরে এলে এই এক ঝামেলা।
ঘুমের সময় যায় পাল্টে । অসময়ে ঘুম । কাজ কম্মের সব বারটা বাজে।
ঘড়িতে সময় দেখল রীনা, ভোর চারটে ।
ফোন বেজে উঠল ক্যা ক্যা করে।
অসময়ে ফোন?
উফ, সেই লোকটা জ্বালাচ্ছে আবার। রোজ রোজ ফোন করে টাকা চায়।
কাল ছিল কুড়ি হাজার টাকা। আজ বলে চল্লিশ হাজার।
রীনা কেই কেউ ধার দিলে বলে ভাল।
বাড়ির mortgage, ছেলে মেয়ের কলেজ আর হোস্টেল এর পড়ার খরচ। শাড়ি, গয়না, গাড়ী, তেল...খরচের তো আর শেষ নেই।
রত্না কে বলছিল কাল, একটা বর এবার একটা খুঁজতেই হবে । বড়লোক হলেই ভাল। তাহলে রীনা চাকরি ছেড়ে নিশ্চিন্তে ঘরে বসে বাংলা চ্যানেল দেখবে দিন রাত।
রত্না বলল, পেলে ও ই আগে নেবে।
আজকাল ছেলেরা চালাক হয়ে গেছে। বিয়ে করতে চায়না।
উঠে চা এর চুপ নিয়ে ফেসবুক নিয়ে বসল রীনা।
আবার ফোন।
জ্বালাল তো লোকটা।
খ্যাঁক করার আগেই রত্নার গলা পেল।
‘কি রে, কাল রাত একটার সময় না ফিরলি? আবার উঠেছিস?’
‘ওহ, তুই?কি করব জেটল্যাগ ...‘
‘জেটল্যাগ না রঞ্জন কে দেখে মাথা বিগড়াল আবার?’
‘রঞ্জন আবার কে? চিনি না তাকে।তুই কি করিস ভোরে?‘
আরে আর বলিস না। একটা প্রেমিক যাও বা জোটালাম, তার মনরক্ষা করতে করতে প্রান যায় আর কি ।‘ রত্না হেসে উঠল ফোন এর ওপাশ থেকে ।
‘কেনরে আবার কি বলে বুড়ো সাহেব টা?’ রীনা ও হেসে বলল।
‘বয়েস এই বুড়ো । energy দেখলে আমি লজ্জা পাই।‘ রত্না বলল।
‘তোর ই বা কম কি? সারাদিন তো busy থাকিস।পাওয়াই যায় না তোকে।’রীনা বল্ল।
‘সে তো প্রেমিক জোটাতে ব্যাস্ত ছিলাম। এখন তো একটু আরাম করার কথা । তা না। ভোর এ উঠে ছোট যোগ ব্যায়াম করতে।‘ রত্না অভিযোগের সুরে বলে।
‘‘handsome millionaire’ ও চাই, আবার কষ্ট ও করবে না, তা কি করে হবে?আমাকে তো একটা জুটিয়ে দিলিনা’ রীনা বলে।
‘রঞ্জন এর ঘোর থেকে বেরো আগে। তারপরে কথা বলিস।‘
‘কি তখন থেকে রঞ্জন রঞ্জন করছিস বলতো? রঞ্জন এর কথা আমি মোটেও ভাবি না।‘
‘সেটা তুই নিজের মন কে বোঝা। রঞ্জন তোকে কোনদিন ই ভালবাসে নি।কেন যে তুই নিজের জীবন টা নষ্ট করছিস...’
‘নষ্ট আবার কি? বয়স তো অনেক হল। আর কটা দিন কেটে গেলে ই মুক্তি।‘
‘মুক্তি পেতে হলে আগে রঞ্জন এর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত কর।‘
‘উফ, তুই সেই এক কথা বলেই যাবি । থাম না।‘ রীনা ক্লান্ত স্বরে বলল।
‘থামিয়ে ই তো রেখেছিস । কত ছেলে তোকে বিয়ে করতে চায়। একবার হ্যাঁ বল্লেই হয়ে যাবে।‘ রত্না বল্ল।
‘বিয়ে আমি করতে চাই না আর।‘ রীনা উত্তর দিল।
‘রঞ্জন কেও না?’ রত্না জিজ্ঞেস করল।
‘ওর কথা আলাদা।‘ রীনা আস্তে আস্তে জবাব দিল।
‘কেন?আলাদা কেন?’রত্না ছাড়বে না আজ মনে হল।
‘তোর বুড়ো সাহেব নিতে আসেনি এখন ও?’ রীনা কথা ঘোরালো।
‘এসে পড়বে, কথা ঘোরাস না ।কি আছে ওর?’
‘কিছু নেই বাবা। ওকে ভালবাসি । ব্যাস , এটুকু ই আছে । ‘
‘এক তরফা ভালবাসা হয়?’
‘না হলে কি করব? অ-ভালবাসতে তো পারব না।‘রীনা আস্তে আস্তে জবাব দিল।
‘ভাল বলেছিস। অ-ভালবাসা। হা হা। তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মর তুই।‘
‘চটিস কেন? কি করতে হবে বল না?’ রীনা বল্ল।
‘আমার সাহেব এসেছে। ঘুরে এসে কথা হবে। রান্না করে রাখিস। যোগ এর পরে খিদে পাবে খুব।
রত্না আসা মানে ই ডাল ভাত, আলুসেদ্দ, পোস্ত বাটা খাবে। সাহেব টা এলে ঝামেলা। একে তো ইংরেজি তে কথা বলতে হবে।তার ওপর তার জন্য চিকেন, বীফ বা কিছু রান্না করতে হবে।কেন যে রত্না ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। বয়স তো দ্বিগুণের ও বেশী।দুজনের কিছুই মিল নেই। এ লম্বা ও বেঁটে। এ মতা, ও রোগা। এ গায় তো ও নাচে।ছিল ভাল। আসলে দিব্যেন্দু র সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে ই রত্না বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেল। রত্নার সাথে সম্পর্ক চলা কালিন ই দিব্যেন্দু , রত্নার ই বান্ধবী মিলা র সাথে প্রেম করা শুরু করল। গতবছর দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে ও করে নিল। রত্না ও তাই বিয়ে করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দিবেন্দু কে ভুলতে কি ও পারবে? দশ বছরে ও তো রঞ্জন কে মন থেকে সরাতে পারল না রীনা। কোন ছহেলের সাথে মিশতে ও পারে না। বিয়ে তো দুরের কথা।
‘তোমার কি আমার কথা একবার ও মনে হয় না রঞ্জন?’ জানলা র দিকে তাকিয়ে রত্না ভাবল কিছু।
লিসা কে নিয়ে রঞ্জন তো সুখে ই আছে। লিসার মেয়ে কে ই দত্তক ও নিয়ে নিয়েছে।
কাল ও তিনজনে ই রবি র ছেলে র জন্মদিনে এসেছিল।
রীনা কথা বলেনি। রঞ্জন এর কাছ থেকে দূরে দূরে ই থাকছিল।
লিসা এসে কথা বলেছে।
লিসা র মেয়ে টাকে ও আদর করেছে।
রত্না আবার রেগে যায় । বলে ‘ তোর আবার আদিখ্যেতা করে কথা বলার কি দরকার?’
‘লিসার ওপর রাগ করে কি লাভ?’ রীনা হাসে।
‘তোর কাছ থেকে রঞ্জন কে নিয়ে নিল, তাও তোর রাগ হয়না?’ রত্না বলে।
‘কেউ কাউকে নিতে পারে না। যে যাবার সে চলে যাবে ই। সে কোন দিন আমার ছিল ই না।‘
রঞ্জন কোনদিন রীনা কে প্রেম নিবেদন করেনি। বরং লিসা কে বিয়ে করার সময় রীনা যখন রঞ্জন কে জিজ্ঞেস করেছিল ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ রঞ্জন?’
রঞ্জন জবাব দিয়েছিল, ‘কবে ধরেছিলাম, যে ছাড়ব?’
রীনা র কান্না কাটি তেও রঞ্জন এর মন গলেনি।
ও বলেছিল একটা কথা,’ তুমি ভাবলে কি করে ? আমি তো কিছু কথা দেই নি।‘
না দাও নি । কথা দাও নি। তবে কেন জন্মদিনে রাত বারটায় এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে কেক খাওয়াতে? কেন আসতে তুমি আমার কাছে? কেন বলেছিলে রাজার সাথে বন্ধুত্ব না রাখতে? আমি তো রাজা কে ভালবাসি না ।আমি তো তমাকে ভালবাসি রঞ্জন। তুমি তো এগুলো কিছু ই মনে রাখলে না। লিসার কাছে চলে গেলে...
‘তুমি তো সেই যাবেই চলে...কিছু তো না রবে বাকি।‘
গান চালিয়ে রীনা রান্না চাপাল।
বেল এর আওয়াজ । কাপড়ে হাথ মুছতে মুছতে দরজা খুলতে রাজা কে দেখতে পেল।
‘তুমি?’ রীনা বলল।
‘চলে যাব?’ রাজা মিটিমিটি হাসছে।
‘না, মানে, এ সময় ...আমি ভাব্লাম রত্না।‘
‘আমি কি রত্না র মতন দেখতে?’
‘না মানে, ওর আসার কথা।আমি পোস্ত বাটছি?’
‘পোস্ত? আমার খুব প্রিয়। তাহলে তো খেয়ে যেতে ই হচ্ছে।‘ বলে রাজা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল।
‘...তো সেই যাবেই চলে...‘
গান টা বন্ধ করে দিল রাজা।
‘কি হল? বন্ধ করলে?’
‘তুমি থাকতে অন্য মেয়ের গান শুনতে পারিনা আমি।তুমি সবচেয়ে ভাল গান করো‘ রাজা বলল।
‘তোমার মাথা আমার মুণ্ডু।‘ কপালে চুল সরাতে গিয়ে হলুদ লেগে গেম মুখে রত্নার।
‘দাঁড়াও,দাঁড়াও, ...সুন্দরীর এই মোমেন্ট টা ধরি।‘ বলেই ফোন এ ছবি তুলতে লাগল।
‘কত আর ছবি তুলবে? ফোন ভরতি তো আমার ছবি।‘ রীনা হাসল।
‘জতদিন? ফোন ভরতি তো আমার ছবি।‘ রীনা হাসল।
‘যতদিন না তুমি ‘হ্যাঁ’ বলবে ...’ রাজা হেসে বলল।
‘হ্যাঁ বললে আর তুলবে না? বা রে?’ রীনা বল্ল।
‘তখন তো সারাক্ষন সামনে বসে দেখব।‘ রাজা বল্ল।
‘সারাক্ষন দেখলে হবে?খাব দাব না?’ রীনা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল।
‘খাব তো বটে ই......’ বলতে বলতে রত্না ঢুকল বলল ...’কি খাবার কথা হচ্ছে?’
‘বান্ধবী কে বোঝান, আর কতকাল অপেক্ষা করিয়ে রাখবে?দশ বছরে তো চুল সব সাদা হয়ে গেল।‘ রাজা বল্ল।
‘তুমি তো আমাদের হাটুঁর বয়সী ।তুমি এ কথা বললে তো আমরা কোথায় যাই বল? রত্না হেসে বলল।
‘ভালবাসায় কি আর হিসাব চলে? আপনার সাহেব বাবাজী কোথায়?’
‘বুড়ো কে বাড়ি পাঠালাম, বললাম আজ গার্লস ডে আউট।থাকলে আড্ডা মারা যাবে না।‘ রত্না হাসল।
‘আমি তাহলে যাই, আপনারা আড্ডা দিন’ রাজা উঠে দাঁড়ালো।
‘আরে বস । তোমাকে পেয়েছি যখন, তখন আজ একটা হেস্ত নেস্ত করতে হবে। রত্না টেনে বসাল রাজা কে।
‘ওরে বাবা। ভয় পাচ্ছি এবার।‘ রাজা বসল।
‘প্রস্তাব টা দাও দেখি।‘ রত্না বলল।
‘কি সব যা তা বলছিস ...’ ও পাশ থেকে রীনা বল্ল।
‘ঐ দেখুন, শোনার আগেই চেঁচায়। বলি কি করে?’ রাজা বল্ল।
‘তুই চুপ কর। আমরা দুজনে ঠিক করব।‘ রত্না বল্ল।
‘প্রস্তাব তো দেওয়াই আছে। আঙটি ও রাখা আছে রান্না ঘরের টেবিল এ।যেদিন পরবে, সেদিন ই হবে।‘ রাজা হাসল।
‘কি সাঙ্ঘাতিক, তুই বলিস নি তো এ কথা?’ রত্না লাফিয়ে রান্না ঘরে গেল।
‘আরে, এরকম হয় না কি?’ রীনা বল্ল।
‘কেন না?’ রত্না বল্ল।
‘আরে , ও কত ছোট।‘ রীনা আমতা আমতা করল।
‘আমি ও তো জন এর চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট।‘ রত্না বল্ল।
‘ছেলেরা বড় হলে কিছু হয়না...মেয়েরা...’ রীনা যুক্তি খাড়া করল।
‘ব্যাস, শুধু এই টুকুই?’রাজা বল্ল।
‘না, মানে...’ রীনা কিছু বলার চেষ্টা করতে ই রাজা বল্ল।
‘তোমাকে তো আমায় ভাবাসতে হবে না। আমাকে ভাল না হয় একটু বাসতে দিও।‘
রাজার কথা শুনে রত্না কেঁদে ফেলল ভ্যাক করে।
রীনা কথা ঘোরানোর জন্য বল্ল,’তোমরা টেবিল এ বস গিয়ে। আমি খাবার দিয়েছি।‘
রাজা আর রত্না টেবিল এ বসল। থমথমে একটু পরিবেশ টা।
রত্না রীনা কে ডাকল। কি রে আসবি না তুই?
রীনা এসে টেবিল এ বসল। হাথের আঙ্গুল এ হীরের আঙটি টা তখন জ্বল জ্বল করছে। .........copyright @manidipa